বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৮ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১

পূণ্য অর্জনের অন্যতম রাত শবে ক্বদর

amarsurma.com

মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
রহমত, মাগফিরাত ও নাযাতের বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে প্রতি বছর হাজির হয় মাহে রমযান। পবিত্র মাহে রমযানকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম দশদিন রহমত, মধ্যম দশদিন মাগফেরাত ও শেষের দশদিন দোযখ হতে মুক্তি। রমযান মাসে একটি পূণ্যময় রাত্রি রয়েছে, যাকে বলা হয় শবে ক্বদর বা পূণ্যবান রাত্রি। এই রাত্রের মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআন শরীফে ইরশাদ হচ্ছে, ‘শবে ক্বদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম’। হাজার মাস ৮৩ বছর ৪ মাসে। শবে কদর সম্পর্কে হাদীস শরীফে উম্মাহাতুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, ‘আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.! যদি আমি জেনে যাই যে অমুক রাত শবে ক্বদর, তবে কি দোয়া পড়ব? তিনি বললেন, এই দোওয়া পড় (আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুভভুন তুহিববুল আফওয়া ফাআফু আন্নী) ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমার প্রতীক, ক্ষমাকে পছন্দ কর। অতএব আমাকে ক্ষমা কর’। (আহমদ, ইবনে মাজা, তিরমিজী)
অন্য একটি হাদীসে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. রমজানের শেষ দশকে এতেক্বাফ করতেন, ওফাত পর্যন্ত তাঁর এই আমল অব্যাহত ছিল। তারপর পত্মীগণ এতেক্বাফ করতেন। (বুখারী)
রমযানুল মোবারকের প্রতিটি ঘন্টা, মিনিট ও সেকেন্ডকে গণিমত মনে করা উচিত। যতদূর সম্ভব এ মাসে সৎকাজ করে নিবে এবং সওয়াব লুটে নিবে। এছাড়া রমজানের শেষ দশ দিনের গুরুত্ব অনেক বেশি। রমজানের শেষ দশকে এতেক্বাফ করা হয়। রাসূলুল্লাহ সা. প্রতিবছর এসব দিনে এতেক্বাফ করতেন। তাঁর পত্মীগণও এতেক্বাফ করতেন। তাঁর ওফাতের পরও তারা তা অব্যাহত রাখেন। এতেক্বাফে অনেক বড় উপকার রয়েছে। এতে মানুষ একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। এ সময়ে শবে ক্বদরও নসিব হয়ে যায়। পুরুষরা মসজিদে এতেকাফ করবে যেখানে পাঞ্জেগানা নামাজ জামাতে আদায় করা হয়। মহিলারা আপন গৃহের মসজিদে এতেকাফ করবে (গৃহের যে জায়গাটি তারা নামাজের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছে, সেটিই তাদের মসজিদ)।
রমযানের বিশ তারিখে আসর নামাযের পর সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে এতেকাফের জায়গায় প্রবেশ করবে এবং ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। সেখানেই নিদ্রা যাবে, পানাহার করবে, কোরআন পড়বে এবং তাসাবহ পাঠে মশগুল থাকবে। যতদূর সম্ভব রাত জেগে এবাদত করবে, এতেকাফে স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ সম্পর্কের কাজ জায়েয নয়; না দিনে, না রাতে। প্রস্রাব, পায়খানার জন্য এতেকাফের জায়গা থেকে বাইরে যাওয়া দুরস্ত।
এতেকাফে কথাবার্তা বলা, উপদেশ দেওয়া, মন্দ কাজে নিষেধ করা, ছেলে-পেলে, চাকর-চাকরানীদের গৃহের কাজকর্ম বলে দেওয়া ইত্যাদি সব জায়েয। নারীর জন্য এটা সহজ যে, সে গৃহে আপন জায়গায় বসে বসে গৃহের কাজকর্মও বলে দিবে। এতেকাফে নারীর মাসিক শুরু হয়ে গেলে তার এতেকাফ সেখানেই খতম। রমজানের শেষ দশকের এতেকাফে এরূপ হলে বিজ্ঞ কোন আলেমের কাছে জিজ্ঞাসা করে কাযা করে নিবে।
রাসূলে আকরাম সা. বলেন, ‘এতেকাফ মানুষকে গোনাহ থেকে বিরত রাখে এবং তার জন্য সে সব নেক কাজের সওয়াব জারি থাকে, যেগুলো এতেকাফের কারণে সে আনজাম দিতে অক্ষম হয়’। (মেশকাত)
হাদিসে ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহার পূর্বেকার রাতেও যিকির ও নফল নামাজ পড়ার ফজিলত বর্ণিত আছে। বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি উভয় ঈদের পূর্বেকার রাতকে এবাদত দ্বারা জীবিত রাখে, তার অন্তর কিয়ামতের দিন মৃত হবেনা, অথচ সেদিন অন্যান্যদের অন্তর সমূহ মৃত হবে’। (তারগীব, তারহীব)
রমযানুল মোবারকের শেষ দশকে শবে ক্বদর হয়, যা অত্যন্ত বরকতময় রাত। কোরআন মাজিদে এরশাদ হয়েছে, ‘শবে কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম’। হাজার মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস হয়। শবে কদরকে হাজার মাসের সমান বলা হয়নি; বরং হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম বলা হয়েছে। এখন এই উৎকৃষ্টতা কি পরিমাণ, তা আল্লাহ তায়ালাই জানেন। মুমিন বান্দার জন্য শবে কদর অত্যন্ত কল্যাণময়। এক রাত জেগে এবাদত করা আর হাজার মাসেরও অধিক এবাদতের সওয়াব পাওয়া এরচেয়ে বেশি আর কি চাই? এ কারণে হাদিসে বলা হয়েছে ‘যে ব্যক্তি শবে ক্বদর থেকে বঞ্চিত হয়, সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল। আর শবে ক্বদরের কল্যাণ থেকে সেই বঞ্চিত হয়, যে পরিপূর্ণ বঞ্চিত’। (ইবনে মাজা)
উদ্দেশ্য এই যে, কয়েক ঘণ্টার রাত্রিতে এবাদত করে নিলে হাজার মাসের চেয়েও বেশি এবাদত করার সওয়াব পাওয়া যায়। কয়েক ঘণ্টা জাগ্রত থেকে মনকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে এবাদত করে নেয়া তেমন কোন কষ্টের কাজ নয়, যা সহ্যের অতীত হবে।
কষ্ট সামান্য এবং সওয়াব বিশাল। কেউ এক পয়সা ব্যবসায়ে লাগিয়ে বিশ কোটি টাকা মুনাফা পেলে তার আনন্দের সীমা থাকবে কি? যে ব্যক্তি এমন বড় মুনাফার সুযোগ পেয়েও অমনোযোগী থাকে, তাকে পূর্ণমাত্রার বঞ্চিত ছাড়া আর কি বলা যায়? পূর্ববর্তী উম্মতসমূহ দীর্ঘায়ু ছিল। এই উম্মতের আয়ু বড় জোর ৭০/৮০ বছর। আল্লাহপাক অনুগ্রহপূর্বক এই উম্মতকে শবে ক্বদর দান করেছেন এবং এক রাতের ইবাদতের মর্যাদা এক হাজার মাসের চেয়েও বেশি করে দিয়েছেন। পরিশ্রম কম হল এবং সময়ও কম লাগল। কিন্তু সওয়াবে পূর্ববর্তী উম্মতদের ছাড়িয়ে গেল। আল্লাহ তাআলার এত বেশি কৃপা ও দয়া দাক্ষিণ্যের পর যদি কেউ গাফেল হয়ে শুয়ে থাকে, তবে তার মত নালায়েক আর কে হবে? অতএব রমযানের কোন মুহূর্তকে বিনষ্ট হতে দিবেনা। বিশেষত শেষ দশকে এবাদতের প্রতি বিশেষ যতœবান হবে। এতে শবে ক্বদরে জাগরণের খুব ফিকির করবে এবং শিশুদেরকেও উৎসাহিত করবে। হযরত আয়েশা রা.-এর উপরোক্ত হাদিসে শবে ক্বদরে পড়ার জন্য যে দোয়া শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তাতে না টাকা-পয়সা প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে, না জমিন, না ঐশ্বর্য্য। প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে কেবল ক্ষমা। আসলে আখেরাতের ব্যাপার সর্বাধিক কঠিন। সেখানে আল্লাহ ক্ষমা করলে উদ্ধার পাওয়া যাবে। ক্ষমা না পেলে এবং আজাবে গ্রেফতার হলে দুনিয়ার সকল নেয়ামত, আনন্দ ও ধন-ঐশ্বর্য্য বেকার হবে, সুতরাং ক্ষমাই আসল। এক হাদিসে এরশাদ হয়েছে ‘যে ব্যক্তি শবে ক্বদরে ঈমান সহকারে এবং সওয়াবের নিয়্যাতে এবাদাতে দ-ায়মান থাকে, তার অতীত সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে’।
এবাদতে দ-ায়মান থাকার অর্থ নামাজ, তেলাওয়াত ও জিকিরে মশগুল থাকা, সওয়াবের নিয়্যাত রাখা অর্থ রিয়া ইত্যাদি খারাপ নিয়্যাতে এবাদতে মশগুল না হওয়া, বরং এখলাছ সহকারে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াব আশা করে এবাদতে লেগে থাকা। এ প্রসঙ্গে আরও জানা দরকার যে, উপরোক্ত হাদিস এবং এ ধরণের আরও অনেক হাদিসে গোনাহ ক্ষমা করার কথা আছে। আলেমগণের এ বিষয়ে ইজমা আছে যে, কবীরা গুনাহ তওবা ব্যতিত মাফ হয়না। সুতরাং যেখানে হাদিসে গোনাহ মাফ হওয়ার কথা আসে, সেখানে অর্থ হয় সাগিরা গোনাহ। মানুষের তরফ থেকে সাগিরা গুণাহই অনেক বেশি সংগঠিত হয়।
হাদিসে বর্ণিত আছে যে, রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে ক্বদর তালাশ করো। তাই রমযানের ২১, ২৩, ২৫, ২৯ তারিখের রাত্রে জাগ্রত থাকা ও এবাদত করার প্রতি বিশেষ যতœবান হবে। বিশেষত ২৭ তারিখের রাত্রে অবশ্যই জাগবে। কেননা এ রাতে শবে ক্বদর হওয়ার আশা বেশি। হযরত ওবাদা রা. বলেন, নবী করিম সা. একদিন আমাদেরকে শবে ক্বদরের সঠিক তারিখ জানানোর জন্য বাইরে এলেন। তখন দু’জন মুসলমান পরস্পরে ঝগড়া করছিলো। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, ‘আমি শবে ক্বদরের কথা জানানোর জন্য এসেছিলাম। কিন্তু দু’ব্যক্তির ঝগড়া দেখার কারণে এর নির্দিষ্ট তারিখ আমার মন থেকে উধাও করে দেয়া হয়েছে। এই উধাও করে দেয়া আল্লাহর জ্ঞানে মঙ্গলজনক হওয়া অসম্ভব নয়’। (বুখারী)
এই হাদিস থেকে জানা গেলো যে, পারস্পরিক ঝগড়া বিবাদ খুবই খারাপ কাজ। এর কারণে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সা.-এর মন থেকে শবে কদরের নির্দিষ্ট তারিখ তুলে দিয়েছেন। কোন কোন দিক দিয়ে এটাও উম্মতের জন্য মঙ্গল জনকই হয়েছে।
আলেমগণ শবে ক্বদরকে গোপন রাখার কয়েকটি উপযোগিতা বর্ণনা করেছেন। এক. শবে ক্বদর নির্দিষ্ট হয়ে গেলে অনেক মানুষ অন্যান্য রাতে মোটেই এবাদত করতো না, বর্তমান অবস্থায় আজই শবে ক্বদর হতে পারে এই সম্ভাবনার কারণে একাধিক রাতে এবাদত করার তওফিক নসিব হয়ে যায়।
দুই. অনেক মানুষ গোনাহ না করে থাকতে পারে না। নির্দিষ্ট রাতে শবে ক্বদর হলে জানা থাকা সত্ত্বেও তারা গোনাহ করার দৃষ্টতা প্রদর্শন করতো, যা তাদের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক হতো।
তিন. শবে ক্বদর নির্দিষ্ট থাকলে কোন কারণে কারও এবাদত সে রাতে বাদ পড়লে অন্য কোন রাতে প্রফুল্ল মনে জাগ্রত থাকা তার নসিব হতো না। কিন্তু এখন প্রফুল্ল মনে রমজানের কয়েকটি রাতের এবাদত নসিব হয়ে যায়।
চার. অনির্দিষ্ট থাকার কারণে শবে ক্বদরের খোঁজে যতগুলো রাত এবাদতে অতিবাহিত হয়, সবগুলোর আলাদা সওয়াব পাওয়া যায়।
পাঁচ. রমযানের এবাদতের কারণে আল্লাহ তায়ালা ফেরেস্তাদের কাছে গর্ব করেন, শবে ক্বদর অনির্দিষ্ট থাকলে গর্বের সুযোগ বেশি। এ কারণে যে, জানা না থাকা সত্ত্বেও কেবল সম্ভাবনার ভিত্তিতে রাতের পর রাত জেগে এবাদত করে। এগুলো ছাড়া আরও অনেক উপযোগিতা থাকতে পারে।
হাদিস শরিফে হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশক এসে গেলে রাসূলুল্লাহ সা. কোমর বেঁধে এবাদতে আত্মনিয়োগ করতেন। তিনি সারারাত এবাদত করতেন এবং গৃহের লোকজনকেও জাগিয়ে দিতেন’। (বুখারী, মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে আছে, ‘রাসূলে করিম সা. রমজানের শেষ দশদিনে যেরূপ পরিশ্রম সহকারে এবাদত করতেন, অন্য সব দিনের এবাদতে এত পরিশ্রম করতেন না। (মুসলিম)
উলামায়ে কিরামগণ ‘কোমর বেঁধে নেয়ার’ দ্বিবিধ মতলব বর্ণনা করেছেন। এক. খুব পরিশ্রম ও চেষ্টা সহকারে এবাদত করতেন এবং সারারাত এবাদতে জাগ্রত থাকতেন। দুই. রাতে পতœীদের সাহচর্য থেকে দূরে থাকতেন। কেননা সমগ্র রাত্রি এবাদতে অতিবাহিত হয়ে যেত এবং এতেকাফও করতেন। তাই রমজানের শেষ দশকে স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ সর্ম্পকের সুযোগ থাকত না।
হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, ‘রমজানের শেষ রাত্রে মুসলিম উম্মাহর মাগফেরাত করা হয়। আরজ করা হল, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.! এর অর্থ কি শবে ক্বদর? তিনি বললেন, না। শবে ক্বদরের ফযিলত ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে যে আমল করে, তাকে তার পূর্ণ প্রতিদান তখন দিয়ে দেয়া হয়, যখন তার আমল শেষ হয়ে যায়। রমযানের শেষ রাতে আমল পূর্ণ হয়ে যায়। তাই মাগফেরাত দিয়ে দেয়া হয়’। (মিশকাত)
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শবে ক্বদরের মর্যাদা রক্ষা করে এর পূর্ণ ফযিলত অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক পরিচিতি : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; শিক্ষার্থী, এলএলবি (১ম পর্ব), মেট্রোপলিটন ল’ কলেজ, সিলেট, সম্পাদক: আমার সুরমা ডটকম ।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com